June 18, 2025

শিরোনাম
  • Home
  • জাতীয়
  • প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক

Image

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আজ ব্যাংককে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক দশকের মধ্যে এটিই ছিল দুই নেতার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশের নেতারা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও খোলামেলা আলোচনার মনোভাব নিয়ে একে অপরকে স্বাগত জানান। ৪০ মিনিটের এই বৈঠক ছিল অকপট, ফলপ্রসূ এবং গঠনমূলক।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ ভারতকে অত্যন্ত মূল্যবান বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে। আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব গভীরভাবে প্রোথিত ইতিহাস, ভৌগোলিক সান্নিধ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে ভারতের সরকার ও জনগণের অবিচল সমর্থনের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।”

যদিও এটি ছিল দুই রাষ্ট্রপ্রধানের প্রথম সরাসরি বৈঠক, অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন যে, গত আট মাস ধরে বাংলাদেশ ও ভারত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সংলাপের মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে।

দুই দেশের মধ্যকার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “মহামান্য, আমরা চাই আমাদের সম্পর্ককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে, যা উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।”

অধ্যাপক ইউনূস, যিনি বর্তমানে বিমসটেক (BIMSTEC)-এর চেয়ারপারসন, সাত সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বাস্তবায়নে ভারতের সমর্থন কামনা করেন।

তিনি গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অধ্যাপক ইউনূসকে বিমসটেকের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানান এবং ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভারতের জন্য বাংলাদেশ সম্পর্ক সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। আমাদের দুই দেশের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই সুদৃঢ়।”

প্রধানমন্ত্রী মোদি অধ্যাপক ইউনূসের বৈশ্বিক খ্যাতির কথা স্মরণ করেন এবং বলেন, ভারত একটি অগ্রসর, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সবসময় সমর্থন করবে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “ভারত বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সাথে, কোনো দল বা ব্যক্তির সাথে নয়।”

অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি ভারতের কাছে উত্থাপন করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন গণমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন এবং দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, যা ভারতের দেওয়া আতিথেয়তার অপব্যবহার।

তিনি বলেন, “তিনি ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উসকানিমূলক অভিযোগ করে চলেছেন। আমরা ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, তিনি যেন এসব উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (OHCHR) তদন্ত প্রতিবেদনের প্রসঙ্গও টানেন, যেখানে বলা হয়েছে যে, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীদের দ্বারা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সময়ে প্রায় ১,৪০০ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ শিশু। প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভ দমনকালে হত্যা, নির্যাতন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি আদেশ দিয়েছিলেন—”বিক্ষোভকারীদের নেতা চিহ্নিত করো, তাদের হত্যা করো এবং লাশ গুম করো।”

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণেই শেখ হাসিনাকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। তিনি পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, “ভারতের সম্পর্ক কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সাথে নয়, বরং একটি দেশের সাথে।”

অধ্যাপক ইউনূস সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে যৌথভাবে কাজ করলে অনেক পরিবারকে দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। এটি পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস তৈরির পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করবে।”

তিনি বলেন, “প্রতিবার সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর শুনলে আমার মনে কষ্ট হয়। আমি ভারতকে অনুরোধ জানাই, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।”

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, “ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কেবল আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং এই ধরনের হতাহতের ঘটনা ভারতের ভেতরে ঘটে।” তবে, উভয় নেতা এ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে তার আশাবাদের কথা ব্যক্ত করেন এবং বলেন, “বাংলাদেশ বিমসটেকের দৃশ্যমানতা বাড়াতে চায় এবং এই সংস্থাকে এমন একটি কার্যকর ও গতিশীল সংস্থায় পরিণত করতে চায়, যা অঞ্চলটির মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে।”

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবর অনেকাংশে অতিরঞ্জিত এবং বেশিরভাগই ভুয়া সংবাদ।” তিনি ভারতীয় নেতাকে অনুরোধ জানান, “আপনারা চাইলে নিজেদের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে সরেজমিন তদন্ত করতে পারেন।”

তিনি আরও বলেন, “আমি ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনার ওপর নজরদারির জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা চালু করেছি, এবং আমাদের সরকার এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে।”

দুই নেতা তাদের গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ আলোচনা শেষ করেন একে অপরের সুস্বাস্থ্য কামনা করে এবং উভয় দেশের জনগণের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।

Scroll to Top