বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত নিনা পি. কেইংলেট -এর নেতৃত্বে ফিলিপাইন দূতাবাস বৃহস্পতিবার (১৯ জুন ২০২৫) ঢাকার র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে ১২৭তম ফিলিপাইন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি জাঁকজমকপূর্ণ কূটনৈতিক সংবর্ধনা আয়োজন করে।

এই বিশেষ আয়োজনে বাংলাদেশের সরকার, কূটনৈতিক কোর, ব্যবসায়ী সমাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা, গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ফিলিপিনো কমিউনিটির সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মধ্যকার সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃঢ়তার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ফিলিপাইন ছিল প্রথম দিকের দেশগুলোর একটি যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি দুই দেশের মধ্যকার গল্প বলার ঐতিহ্য, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের মতো সাংস্কৃতিক মিল-সম্পর্ক তুলে ধরেন এবং সাম্প্রতিক একটি বাংলাদেশ-ফিলিপাইন যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করেন, যা ৭৮তম কানের চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেছে। উপদেষ্টা ফারুকী ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতসহ সৃজনশীল শিল্পে সরকারিভাবে সহযোগিতার সম্ভাবনার কথাও বলেন।

রাষ্ট্রদূত কেইংলেট তাঁর বক্তব্যে ১২ জুন ১৮৯৮ সালে ফিলিপাইন স্বাধীনতা অর্জনে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি ফিলিপাইনের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, টেকসই উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। বিশেষভাবে রাষ্ট্রপতির ‘এইট-পয়েন্ট সোশিওইকোনমিক অ্যাজেন্ডা’ এবং “আমবিশন নাতিন ২০৪০” কর্মসূচির কথা বলেন, যার লক্ষ্য ২০৪০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত একটি মধ্যবিত্ত-প্রধান সমাজ গঠন।
তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানে ফিলিপাইনের অগ্রাধিকার, সেফারারদের অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং শান্তি ও নিরাপত্তায় নারীদের অংশগ্রহণের মতো বৈশ্বিক বিষয়ে দেশের সক্রিয় ভূমিকাও তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রদূত কেইংলেট বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মধ্যকার ৫০ বছরের দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ওষুধ, টেক্সটাইল এবং পর্যটন খাতে সহযোগিতার প্রসার এবং বাংলাদেশে কর্মরত ফিলিপিনোদের অবদানের কথা উল্লেখ করেন। গার্মেন্টস, শিক্ষা, হসপিটালিটি এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো খাতে তাঁদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিল ফিলিপাইনের ঐতিহ্য ও প্রতিভার অনন্য প্রদর্শনী। ফিলিপিনো বিখ্যাত সোপ্রানো জুটি ‘দ্য নাইটিঙ্গেলস’-এর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা অতিথিদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং তাঁদের উপস্থাপিত একটি জনপ্রিয় বাংলা গানের মাধ্যমে দুই জাতির সাংস্কৃতিক বন্ধনের নিদর্শন ফুটে ওঠে। এছাড়া ফিলিপিনো কমিউনিটির সদস্যদের পরিবেশনায় মারানাও জাতিগোষ্ঠীর রাজকীয় ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ‘সিঙ্গকিল’ অনুষ্ঠানটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
ফিলিপাইন ঐতিহ্যবাহী খাবারের একটি বুফে পরিবেশনের মাধ্যমে অতিথিদের জন্য ছিল দেশটির সমৃদ্ধ খাবার সংস্কৃতি উপভোগের সুযোগ। এ ছাড়াও একটি মিনি এক্সিবিশনের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয় দেশটির হস্তবোনা কাপড়, ঐতিহ্যবাহী গহনা, প্রাকৃতিক পানীয় ও স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রী, যা বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করে।

রাষ্ট্রদূত কেইংলেট প্রধান অতিথি উপদেষ্টা ফারুকীকে ফিলিপাইনের ইলোকোস অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প নিয়ে লেখা ‘ইনাবেল’ নামক একটি কফি টেবিল বই এবং ফিলিপাইনের দেশীয় কাঠে তৈরি ‘বানওয়া কলম’ উপহার দেন—যা ফিলিপিনো সৃজনশীলতা এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক।
রাষ্ট্রদূত অনুষ্ঠানের সফল আয়োজনে সহায়তার জন্য জাতীয় সংস্কৃতি ও কলা কমিশন (NCCA), সেন্ট্রো রিজাল, সম্মানিত কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ আউয়াল, সম্মানিত কনসাল আবদুল্লাহ সালিহ, বাংলাদেশ-ফিলিপাইন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BPCCI) এবং ফিলিপিনো কমিউনিটিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত কেইংলেট বলেন: “দিন শেষে, আমরা একই স্বপ্ন দেখি এবং একই আশাকে লালন করি।” এই বক্তব্যটি দুই জাতির মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব ও শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সম্মিলিত অগ্রগতির জন্য পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষাকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে।