আজ থেকে রাজধানীতে শুরু হয়েছে ১৩তম বিমান বাংলাদেশ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ফেয়ার (বিটিটিএফ) ২০২৫, যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। দেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক মেলার টাইটেল স্পন্সর হিসেবে রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর, ২০২৫) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দূত লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “পর্যটন শুধু ভ্রমণ নয়, এটি বাংলাদেশের পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং মানুষের আন্তরিকতার প্রকাশ। আমাদের দেশের তরুণদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। অন্যান্য খাত যেখানে প্রযুক্তি এবং এআই দ্বারা মানুষকে বিকল্প করা হচ্ছে, পর্যটন ক্ষেত্রে মানবিক সেবা অপরিহার্য, যা আমাদের যুব সমাজকে নতুন সুযোগ ও উদ্ভাবনের পথ দেখায়।”

দূত লুৎফে সিদ্দিকী আরও বলেন, “পর্যটন কেবল দৃশ্যমান সম্পদের ওপর নির্ভর করে না; এটি অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি তৈরি করার শিল্প। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন সুন্দরবন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, পাহাড়ি এলাকা, ঐতিহাসিক স্থান এবং লোকসংস্কৃতি – এগুলো সবই পর্যটকদের জন্য একটি অভিজ্ঞতা। আমাদের উচিত এই অভিজ্ঞতাগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরে মারিনা বে স্যান্ডস বা টেলর সুইফটের কনসার্টের মাধ্যমে তারা এক অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে যা দেশীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। বাংলাদেশও এর চেয়ে কম সুযোগ পাচ্ছে না, আমরা চাই এটিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “পর্যটন শুধু অর্থনৈতিক সেক্টর নয়, এটি একটি মানবিক শিল্প। একজন পর্যটক যদি বাংলাদেশে তার পরিবার এবং শিশুদের সঙ্গে আনন্দময় স্মৃতি তৈরি করতে পারে, সেটিই আমাদের শিল্পের মূল উদ্দেশ্য। পর্যটন শিল্পের সব পক্ষকে — ট্যুর অপারেটর, হোটেল, রিসোর্ট, স্থানীয় সম্প্রদায় — একযোগে কাজ করতে হবে যাতে বাংলাদেশ বৈশ্বিক পর্যটন মানচিত্রে আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সায়েমা শাহীন সুলতানা, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন; নুজহাত ইয়াসমিন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব), বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড; মো. মাইনুল হাসান, অতিরিক্ত আইজিপি, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ; ড. মো. শফিকুর রহমান, এমডি ও সিইও, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স; এবং নায়লা আহমেদ, যুগ্ম সচিব, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মো. রাফিউজ্জামান, প্রেসিডেন্ট, টোয়াব এবং মো. তাসলিম আমিন শুভ, পরিচালক (ট্রেড ও ফেয়ার), টোয়াব।

মেলার উদ্বোধনীতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মো. তাসলিম আমিন শুভ, যিনি বলেন, “বহু বছর ধরে আমরা দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন এবং সমর্থনের জন্য কাজ করছি। এই মেলা শুধু ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম নয়, তরুণ প্রজন্মকে সহায়তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করার একটি বিশেষ সুযোগ। আমরা নতুন প্রজন্মকে পর্যটন খাতে প্রশিক্ষণ, চাকরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিইও ড. মো. শফিকুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরতে বিমান বাংলাদেশ গর্বিত। বিমান শুধু যাত্রী পরিবহন করে না, এটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মানুষের আতিথেয়তার প্রতিনিধি। পর্যটন উন্নয়নের জন্য আমাদের সবার — ট্যুর অপারেটর, হোটেলিয়ার, ট্রাভেল এজেন্সি এবং স্থানীয় সম্প্রদায় — একযোগে কাজ করতে হবে। দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র যেমন সিলেটের চা বাগান, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বা পাহারপুর ও মহাস্থানগড়ের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা তৈরি করে।”

বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাইনুল হাসান বলেন, “পর্যটন মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি চাকরি সৃষ্টি করে, আয় উৎস বৃদ্ধি করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেশের সংযোগ বাড়ায়। বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা অপরিসীম — আমাদের রয়েছে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, প্রাকৃতিক বনভূমি, পাহাড়, ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ এবং অতিথিপরায়ণ মানুষ। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রচারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যটক আগমন বাড়ানো সম্ভব।”

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও নুজহাত ইয়াসমিন যোগ করেন, “ট্যুর অপারেটর এবং গাইডরা পর্যটক এবং গন্তব্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। তারা সমাজে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের একটি সুযোগ দেয়, জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতি বৃদ্ধি করে এবং সংস্কৃতি বিনিময়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নীতি প্রণয়ন পর্যটন শিল্পকে আরও শক্তিশালী এবং উদ্ভাবনী করে তোলে।”

বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সায়েমা শাহীন সুলতানা বলেন, “পর্যটন শিল্প শুধু অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি দেশ এবং দেশের সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এই মেলা বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনাকে প্রদর্শন করার জন্য একটি অনন্য প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন দেশ ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এখানে অংশগ্রহণ করে ব্যবসায়িক আলোচনা, নেটওয়ার্কিং এবং পর্যটন বৃদ্ধির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবে।”

টোয়াব প্রেসিডেন্ট মো. রাফিউজ্জামান তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, “পর্যটন শিল্পকে আরও গতিশীল ও সমৃদ্ধ করতে সরকারি সহায়তা, ভ্যাট হ্রাস, হোটেল রেট নিয়ন্ত্রণ এবং ট্যুর অপারেটরদের প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান অপরিহার্য। যদি আমরা সঠিকভাবে পরিকল্পনা এবং সহযোগিতা করি, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”

এবারের মেলায় পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ ১২টি দেশের পর্যটন সংস্থা, ট্যুর অপারেটর এবং ট্রাভেল এজেন্টরা অংশগ্রহণ করছে। মোট ৪টি হলে ২০টি প্যাভিলিয়ন এবং ২২০টি স্টল থাকবে। আন্তর্জাতিক ও দেশি এয়ারলাইনস, হোটেল, রিসোর্ট, ক্রুজ লাইন এবং হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনীতে অংশ নেবে। এছাড়াও প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, B2B ও B2C সেশন, সেমিনার ও কান্ট্রি প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠিত হবে।











