বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রথাগত ’লিনিয়ার’ মডেল থেকে ’সার্কুলার ইকোনমি’ তেরূপান্তরের অগ্রযাত্রাকে বেগবান করার লক্ষ্য নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলো ‘বাংলাদেশ সার্কুলার ইকোনমি সামিট‘।
মঙ্গলবার ১১ জুন ২০২৪ বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ কর্তৃক আয়োজিত দিনব্যাপী এই সম্মেলনে ফ্যাশন শিল্পের নেতৃবৃন্দ, শিল্পউদ্যোক্তা, সার্কুলারিটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিগণ এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন ।
জার্মান উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ’জিআইজেড’ এর সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় ঢাকার রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে আয়োজিত এই সামিটে চারটি প্লেনারি আলোচনা সভা ও একটি ‘ব্রেক আউট সেশনে’ অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পে সার্কুলারিটি বাস্তবায়নে সুযোগ, চ্যালেঞ্জসমূহ ও সম্ভাব্য উপায় নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ সার্কুলার ইকোনমি সামিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, এমপি। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান, বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন থিজসওয়াউডস্ট্রা, এবং বাংলাদেশস্থ জার্মান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন জ্যানজানোস্কি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজ উদ্দিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, এমপি বলেন, “বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সাসটেইনেবিলিটির দিক থেকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমাদের দেশের উন্নয়ন অনেকটাই পোশাক এবং বস্ত্রশিল্পের উপর নির্ভর করে। আমাদের পোশাকশিল্পে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প দায়িত্বশীল ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। শিল্পের উন্নয়নে আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের এই উন্নয়ন যেন টেকসই হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সার্কুলারিটি এবং উন্নয়নের জন্য সকলের মধ্যে সহযোগিতাই মূল চাবিকাঠি।”
“আমাদের পৃথিবী একটাই। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য আমাদের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিজিএমইএ‘র সাবেক সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “সার্কুলার ফ্যাশন প্রসারের জন্য ব্র্যান্ড এবং উৎপাদনকারীদের মধ্যে সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আপনাদের অংশীদার। আমি সকল ব্র্যান্ডকে অনুরোধ করছি, অনুগ্রহ করে আপনার দাম একটু বাড়ান। অন্যথায় আমরা টিকে থাকতে পারব না।”
“বাংলাদেশ সার্কুলারিটি এবং সাসটেইনিবিলিটির ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। আমাদের শিল্পের অগ্রযাত্রা মসৃণ ছিলনা। আমরা প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করেছি। আমাদের কারখানাগুলো সর্বোচ্চ মান বজায় রাখে। পোশাক উদ্যোক্তারা টেকসই অনুশীলন গুলি গ্রহণ করছে। ইতেমধ্যে বাংলাদেশে ২০০ টিরও বেশি সনদপ্রাপ্ত সবুজ পোশাক কারখানা রয়েছে এবং আরও ৫০০ কারখানা সনদ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষামান রয়েছে। উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে এবং পুনর্ব্যবহারে আরও গুরুত্বারোপের মাধ্যমে বাংলাদেশ সার্কুলার ইকোনমির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সার্কুলারিটি সম্পর্কে আরো জ্ঞান এবং প্রযুক্তির জন্য আমাদের উন্নত দেশগুলির সহায়তা প্রয়োজন।”

বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন থিজসওয়াউডস্ট্রা বলেন, “সার্কুলারিটির দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সাপ্লাই চেইন জুড়ে স্বচ্ছতা আনয়নের উপায়গুলিকে ব্যাপকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাতে উপকরণসমূহের গঠন এবং গুণমান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রবিধান পালন নিশ্চিত করা এবং পরিবেশগত দিকগুলোর স্বচ্ছতার ব্যাপারে ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করা যাবে।”
“বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি সম্ভাবনাময় খাত। একসাথে কাজ করে আমরা সার্কুলার ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি।”
বাংলাদেশস্থ জার্মান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন জ্যানজানোস্কি বলেন, “বাংলাদেশের আরও উচ্চাভিলাষী সংস্কার নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অবশ্যই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রায়শই বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রগামী হিসাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং অনান্য স্টেকহোল্ডারগণ সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তারা যেমন দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, তেমনি উদ্ভাবন ও বিনিয়োগের ব্যাপারেও ভূমিকা রাখতে পারেন।”
“টেকসই উৎপাদনে বিনিয়োগ করা শুধুমাত্র একটি দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তই নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত যা টেকসই উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে জার্মানি ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বৈশ্বিক বাজারে আরও শক্তিশালী করতে পারে।”
“সার্কুলার ইকোনমি বিশ্বে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির একটি মোকাবেলা করতে সহায়তা করে। আর সেটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশে সার্কুলারিটির ক্ষেত্রে অনেক চমৎকার এবং ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে আরো মনোনিবিশেন করতে হবে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আপনারা অনেকেই এ নিয়ে কাজ করছেন। আমি আরো খুশি যে, আজকের এই সম্মেলনে সার্কুলারিটির চ্যালেঞ্জগুলির উপর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, “২০১৬ সালে আমি প্রথম বারের মতো শিল্পবর্জ্যের শতকরা হারের উপর একটি গবেষণা করতে চেয়েছিলাম, এবং বাংলাদেশে সেটি বের করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু এখন সবাই জানে বাংলাদেশে বর্জ্যের শতকরা হার কত। আর এ বিষয়টি আমাকে অনেক গর্বিত করে তোলে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এতদূর এগিয়েছে যে, আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন আমরা দিনদিন আরও উন্নতি করছি।”
“আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। অনুগ্রহ করে এই আন্দোলনে যোগদিন, এবং একদিন আপনি দেখতে পাবেন কিভাবে বাংলাদেশ টেকসই এবং সার্কুলারিতে শীর্ষস্থানীয় হয়ে ওঠে।
“আমাদের সরকার, বেসরকারিখাত, অংশীদার এবং সমস্ত স্টেকহোল্ডাররা একটি অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। পরিবর্তনটা শুরু হয় আপনার আর আমার কাছ থেকে। বাংলাদেশের জন্য সেই অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সবার বড় ভূমিকা রয়েছে।”