বুধবার (৩০ জুলাই, ২০২৫) ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মরক্কো দূতাবাসের আয়োজনে উদযাপিত হলো মরক্কোর জাতীয় দিবস থ্রোন ডে। এদিনটি মরক্কোর বর্তমান সম্রাট মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর সিংহাসনে আরোহণের বার্ষিকী হিসেবে দেশজুড়ে প্রতি বছর উদযাপন করা হয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই দিনটি মরক্কোর জনগণের জন্য জাতীয় ঐক্য, গৌরব এবং উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

থ্রোন ডে শুধুমাত্র মরক্কোর একটি আনুষ্ঠানিক দিবস নয় বরং এটি মরক্কোর জনগণের কাছে তাঁদের রাজাকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর একটি বিশেষ উপলক্ষ। রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর গত ২৬ বছরের নেতৃত্বে মরক্কো আর্থ-সামাজিক খাতসহ অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য শক্তি, কূটনীতি এবং খেলাধুলায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন অর্জন করেছে। দেশটির আধুনিক মহাসড়ক, উচ্চ-গতির রেলপথ (LGV), বিশ্বমানের বন্দর ‘তাংগের মেড’, এবং নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ আজ মরক্কোকে আফ্রিকার উন্নয়নশীল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মাননীয় উপদেষ্টা, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বক্তব্যে তিনি মরক্কো দূতাবাসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এই দিনটি মরক্কোর শক্তি, দূরদৃষ্টি এবং উন্নয়নের প্রতীক। বাংলাদেশ ও মরক্কোর মধ্যে উষ্ণ ও ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এই বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

অনুষ্ঠানে মরক্কোর চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মি. বুশাইব এজ-জাহরি (Mr. Bouchaib EZ-Zahri) উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “এই আনন্দঘন অনুষ্ঠানে আপনাদের সৌজন্যপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি আমাদের আন্তরিকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। থ্রোন ডে মরক্কোর জনগণের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এটি কেবল একটি জাতীয় উৎসব নয়, বরং এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, আত্মবিশ্লেষণের একটি ক্ষণ এবং গর্বের এক প্রকাশ।”
তিনি বলেন, মহামান্য রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-এর শাসনামল চিহ্নিত হয়েছে সাহসী সংস্কার, আধুনিকায়ন ও মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে। এই নেতৃত্ব মরক্কোকে বৈশ্বিক মঞ্চে একটি নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই ধারাবাহিকতায় আগামী বছর মরক্কো ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করা হবে, যা দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক বন্ধন ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের নিদর্শন।

তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আমাদের অংশীদারিত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। চলতি মাসের শুরুতে মরক্কোর ওসিপি গ্রুপ (OCP Group) এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (BADC)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে ২০২৫–২০২৬ মেয়াদে ১১ লাখ টন নন-ইউরিয়া সার সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে। এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক চুক্তি নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব, যার মাধ্যমে টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্য অর্জিত হবে। এতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও গবেষণা সহযোগিতার দিকটিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ মরক্কো থেকে ৪০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফসফেট ও রাসায়নিক সার আমদানি করেছে, যা দেশের মোট সার আমদানির প্রায় ৭৫ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে মরক্কো থেকে বাংলাদেশের আমদানি গড়ে বছরে ২৯ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা অর্থনৈতিক সম্পর্কের দৃঢ়তা ও গতিশীলতা প্রকাশ করে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুই দেশের অংশীদারিত্ব কৃষি খাত ছাড়িয়ে অবকাঠামো, শিক্ষা, পরিবহন, বেসামরিক বিমান চলাচল ও সংস্কৃতি খাতেও বিস্তৃত হয়েছে। সম্প্রতি মরক্কো সফরকালে বাংলাদেশের মাননীয় যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা জনাব আসিফ মাহমুদ সজীব এবং শিল্প, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা জনাব আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে।

বিশেষভাবে শিক্ষা খাতকে তিনি দুই দেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রতি বছর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা মরক্কোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে একাডেমিক বিনিময়, গবেষণা সহযোগিতা এবং দক্ষতা উন্নয়নের পরিসর আরও বাড়ানো হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনও ক্রমেই সুদৃঢ় হচ্ছে। মারাকেশে ওআইসি ইয়ুথ সামিটে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আগামীতে ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল ইয়ুথ সামিট সেই সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকটে মহামান্য রাজার নির্দেশে মরক্কো বাংলাদেশকে জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়েছিল, যা দুই দেশের মধ্যে সহমর্মিতা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।
শেষে তিনি মরক্কোর রাজা মোহাম্মদ ষষ্ঠ-কে (আল্লাহ তাঁকে সহায় করুন) তাঁর দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য ও সুখী জীবনের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, “আমাদের এই উদযাপন যেন মরক্কোয় গৌরব, বাংলাদেশে আনন্দ এবং উভয় দেশের জন্য একটি উজ্জ্বল যৌথ ভবিষ্যতের বার্তা বয়ে আনে। মরক্কো-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চিরজীবী হোক।”
অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মী, গণমাধ্যম প্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।